It starts with one
All I know
So unreal
Watch you go
I tried so hard and got so far
And in the end, it doesn’t even matter…”
গানটা আমার ফোনের রিংটোন। একটানা বেজেই চলেছে। আননোন নম্বর। রিসিভ না করার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু যখন তৃতীয়বারের মতো বাজতে শুরু করলো, তখন রিসিভ করলাম। কুরিয়ার সার্ভিসের ফোন।
আধা ঘন্টা পর বাসার সামনে একটা ট্রাক এসে দাঁড়ালো। হ্যাংলা-পাতলা হাসিখুশি চেহারার ছেলেটা যখন বললো,”ম্যাম,আপনার পার্সেল। আ’ম সিওর,ইউ নিড হেল্প”,তখন আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। ট্রাকভর্তি অনেকগুলো বক্স। সবগুলোই নাকি বইভর্তি। আর তার চেয়েও বিস্ময়ের ব্যাপার, সবই নাকি আমার উপহার।
দুজনে ধরাধরি করে সবগুলো বক্স ভেতরে আনতে সমর্থ হলাম। প্রচন্ড পরিশ্রমের কাজ। ছেলেটাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বললাম। ঠান্ডা পানির শরবতের সাথে চা, বিস্কুট এবং একটা প্যানকেক দিলাম। ওকে দেখে আমার ছোটভাইয়ের কথা মনে পড়লো। অনেকদিন বাড়ি যাই না। কতদিন পরিবারের কারো সাথে দেখা নেই। অথচ দিনশেষে পরিবারই নাকি ম্যাটার করে। টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করি ওর সাথে –
“নাম কী তোমার?”
“শীতল।”
“কিছু মনে করো না। তোমাকে তুমি বলে ডাকছি। তোমার চেহারায় একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে। বয়স হয়তো আমার চেয়ে বেশি হবে না”
“ম্যাম,কোনো সমস্যা নেই। আমি টুয়েলভে পড়ি।”
“ম্যাম বলে ডাকার প্রয়োজন নেই। আপু বলতে পারো। তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো।”
“সিওর ম্যাম মানে আপু।”
“আমার নাম আনিতা। জুনিয়র রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অফ সোশাল সায়েন্সেস”
“সো সুইট অফ ইউ,আপু”
শীতল যাবার জন্য যখন উঠে দাঁড়ালো তখন তার হাতে কিছু টিপস গুঁজে দিতে দিতে বললাম, এত কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ। তবে একা একাই সব গিফট খুলতে দফারফা যাবে আমার। আই থিংক, ইউ উড ইনজয় আনবক্সিং।” শীতল একগাল হেসে বললো, “আপু, আমিও তাই চাইছিলাম। কিন্তু ফরমালিটি করে কিছু বলিনি। একসাথে এত বই কখনো কেউ গিফট পেয়েছে বলে মনে হয় না আমার।” চোখ-মুখে কৌতুহল ফুটিয়ে বললাম, “কত বই এখানে থাকতে পারে?” আবারো হাসলো সে। “ধারণা নেই। এক হাজার হতে পারে,আবার এক লক্ষও হতে পারে।” “তাহলে ইতিহাসের সাক্ষী হও” – বলি আমি।
আনবক্স করতে করতে জিজ্ঞাসা করলাম, “
“কোন কলেজে পড়ছো?”
- “বিএএফ শাহীন কলেজ”
“সায়েন্স?”
- “হ্যাঁ”
“টার্গেট কী?”
- “ফিজিক্স নিয়ে পড়তে চাই।”
“সায়েন্টিস্ট হতে চাও?”
- “অনেকটা এমনই” (লাজুক স্বরে)
“কতক্ষণ কাজ করতে হয় তোমাকে?”
- “পার্ট টাইম কাজ করি। তাও শুধু আমার ফ্লেক্সিবল টাইমে। সপ্তাহে দুদিন ছয় ঘন্টা করে।”
“পড়াশোনার ক্ষতি হয় না?”
- (একগাল হেসে) “আরেহ নাহ! দিনের পড়া দিনে করলেই হয়ে যায়।”
“গ্রেট!”
প্রথম বাক্স খোলার পর একটু থামি। সব বই। ভারী ভারী বই। সব ফিজিক্সের। আপনাদের এতক্ষণ কৌতুহল হবার কথা, এত উপহার কে পাঠিয়েছে। প্রিয় পাঠক, কারো নাম লেখা না থাকলেও আমি হলফ করে বলতে পারি, এগুলো জোহান পাঠিয়েছে। জোহান আমার বন্ধু। আমি ওকে বন্ধুই মনে করি। কিন্তু সে আমাকে মোর দ্যান ফ্রেন্ড মনে করে। ইম্প্রেস করতে সে যেসব পাগলামি করেছে, আজকেরটা সেরা। গুণে গুণে দেখলাম মোট ৪৭টা বই আছে এখানে। কিছু কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ না করে পারছি না। John Toner এর The Physics of Flocking – Birth,Death and Flight in Active Matter. এর দাম সম্পর্কেও আইডিয়া দেয়া যাক। এর মূল্য ১৭২১ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় ২ লক্ষ টাকারও বেশি! Paul G. Hewitt এর Conceptual Physics এর মূল্যমান এরকমই! সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এখানে ২১ লক্ষ টাকারও বই আছে। বইয়ের নাম Understanding Space. লেখকের নাম গুগলে সার্চ করে নিতে পারেন। এসব বই দেশে পাওয়া যায় না। নিশ্চয়ই বাইরে থেকে ইমপোর্ট করতে হয়েছে। জীবনে এত বিস্ময়ের মুখোমুখি খুব কমই হয়েছি!
এরপরে দ্বিতীয় বক্স খুললাম। শীতল বেশ আগ্রহ সহকারে সব করছিলো। চোখমুখে অপার বিস্ময়। একটু পরপরই বলছিলো, “আপু,তুমি সত্যি অনেক লাকি। এত্ত বই!” দ্বিতীয় বক্স থেকে পাওয়া গেল ৫৫ টা বই৷ এগুলোও সব ফিজিক্সের। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। হাঁপিয়ে উঠলাম। রুম ততক্ষণে বইয়ের স্তুপে ভরে গেছে। শীতলকে বললাম,বিশ্রাম নিতে। একসময় উপভোগ করলেও এখন বেশ ক্লান্ত ও। যার প্রমাণ পাওয়া গেলো ওর কথাতেই – “ভাইয়াকে ডাকা উচিত ছিলো। তাহলে বুঝতো,আনবক্সিং এর কষ্ট কতটা।” হাসি আমি। বলি – “ও এখন কল ধরবে না। আনবক্সিং করার ভয়ে নয়,বকা খাওয়ার ভয়ে।” শীতল বলে- “বা রে! তুমি বকা দিতে পারবে তাকে? এত বই দেয়ার পরও?” জবাবে নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নেই। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আবারো নেমে পড়ি আনবক্সিয়ের কাজে। ফিজিক্সের বই ছাড়াও রয়েছে অ্যাস্ট্রোনমি, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, ম্যাথসহ অনেক পিওর সায়েন্সের বই। তাছাড়া সায়েন্স ফিকশন তো আছেই। শীতল বললো, “তোমার বুঝি পিওর সায়েন্সে আগ্রহ ভীষণ…” মাথা নাড়ালাম আমি।
“আমি কি মাঝেমাঝে তোমার থেকে বই ধার নিয়ে পড়তে পারি?”
- “নিশ্চয়ই। যখন খুশি চলে আসবে।”
“থ্যাংক ইউ সো মাচ,আপু।”
- “তবে একটা শর্ত…”
“কী, আপু?”
- “অনেক বড় সায়েন্টিস্ট হতে হবে যেন তোমার নাম বিশ্ববাসী জানে।”
(লাজুক স্বরে) “আমি চেষ্টা করবো, আপু…”
শেষ বিকেলে যখন একে একে ২৫ টা বক্সই খোলা হলো তখন আমার ড্রয়িংরুমকে আর চেনা যাচ্ছে না। বাইরে থেকে কেউ দেখলে বইয়ের দোকান ভেবেও ভুল করতে পারে। সবমিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ১২৫৭! শীতলকে কিছু বই উপহার দিয়ে আমার কার্ড হাতে দিলাম। বললাম, “ইফ ইউ নিড এনি কাউন্ড অফ হেল্প,ফিল ফ্রী টু আস্ক ফর।” বিদায় জানিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন বিছানায় বসলাম,তখন আমি ভীষণ পরিশ্রান্ত। বিছানার ওপর একটা চিঠি।
জোহান আজ বাড়িতে আসেনি। এর অর্থ, শীতলই এক ফাঁকে চিঠিটা রেখে গেছে। এত টাকার বই জোহান নিশ্চয়ই যেনতেন কারো হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হবে না। তার মানে,সবকিছুই জোহানের প্ল্যান ছিলো। শীতল জোহানের পরিচিত কেউ-ই হবে। চিঠিটা খুললাম, ঝকঝকে অক্ষরে লেখা- “আমি জানি,কখনো তোর হৃদয় জয় করতে পারবো না। তবুও আমার মনে হলো,সামান্য উপহারের মাধ্যমেই যদি তোর স্মৃতিতে জায়গা করে নিতে পারি,সেটাই-বা মন্দ কীসে! শুভ জন্মদিন, আনিতা। আমি ঢাকার বাইরে আছি। তা না হলে নিজেই তোর কাজে হেল্প করতাম। এত বই পাবার পর তোর আনন্দটুকু দেখতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু নিরুপায় হয়ে যেতেই হচ্ছে। তবুও কল্পনা করে নিচ্ছি,তুই বেশ খুশি হয়েছিস।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা। জানি না,ছেলেটা কেন এসব পাগলামি করে। এত বই কিনতে ওর যা খরচ পড়েছে, তা দিয়ে এই শহরের একাংশ কেনা যাবে। টাকার অংক বাদ দিলেও বেছে বেছে বইয়ের খোঁজ করা,কোথায় কোন বই পাওয়া যাবে তার হিসাব মেলানো,কবে আসবে,কীভাবে পাঠানো হবে – হাজারো হিসাব-নিকাশ আছে। আজ আমার জন্মদিন বলে এত কিছু কেন করতে হবে? আমি ত বিশেষ কেউ না,নিতান্তই সাধারণ এক মানুষ… হুট করেই মন খারাপ হয়ে যায় আমার। বারান্দায় এসে দোলনায় বসি। অপরাজিতার সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি পত্রপল্লবের পানে! তীক্ষ্ণ গানের সুর আসতে থাকে –
“তারে আমার আমার মনে করি,
আমার হইয়া আর হইলো না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা…”
তিনদিন পর,সন্ধ্যা
স্থান: ন্য হন্যতে ক্যাফে
একই টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে দুটো প্রাণী – আমি এবং জোহান। দুজনের হাতেই কড়া ব্ল্যাক কফির মগ ধরা। মগের অপূর্ব কারুকাজ নজর কাড়বে আপনারও। প্রিয় পাঠক,ভাবতেই পারেন,সন্ধ্যায় কেন ব্ল্যাক কফি খাচ্ছি আমরা। আসলে আমিও যেমন সোশাল সায়েন্টিস্ট, জোহানও সায়েন্টিস্ট। তবে সে ম্যাথামেটিশিয়ান। কাজের চাপ ভালোই গ্রাস করেছে আমাদের। রাত জেগে জেগে আমি করবো SPSS আর সে করবে অয়লারের কোনো এক সমীকরণ নিয়ে কাজ। সে কথা যাক। চলুন, আপনাদেরকে শোনাই কী কথাবার্তা হয়েছিলো আমাদের মাঝে। আরেকটু মনোযোগ দিবেন প্লিজ।
“এসব পাগলামি কেন করিস, জোহান?”
- “এর সঠিক জবাব আমিও জানি না।”
“আমাকে মূল্য পরিশোধ করছিস নাকি?”
- “কীসের মূল্য?”
“তোর সাথে মাঝেমাঝে যে অন্তরঙ্গ সময় কাটে সেটার?”
জোহানের দৃষ্টিতে বিস্ময়! হয়তো ভাবছে, এ কার প্রেমে পড়লাম! এত রুড কেন মেয়েটা?
বেশ জোরের সাথেই সে বললো,
- “মানুষের মূল্য হয় নাকি? হলেও তোর মূল্য কোনোভাবেই দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া আমি কখনো অ্যাপ্রোচ করিনি তোকে। তুই স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে আমাকে অ্যাপ্রোচ করেছিস প্রতিবার।’’
“তাহলে এসবের মানে কী? কেন এত বই দিয়েছিস? টাকার অংকের কথা বাদ দিলেও এর জন্য যে সময় এবং শ্রম প্রয়োজন হয়েছে, তা ভাবতেই আমার অবাক লাগছে।”
- “ভেবে দেখ,কেনো। তুই সোশাল সায়েন্টিস্ট।”
“ ভাবতে চাই না। তুই ডিরেক্টলি বলবি।”
- “এভাবে বলতে চাই না।”
“Ugggghhhhh!!!!”
একটা ব্ল্যাংক চেক বের করি। ওর সামনেই গোটা গোটা অক্ষরে সাইন করে বলি – অংকটা বসিয়ে নিস। কারো থেকে কিছু নিতে ইতস্তত লাগে আমার। শীতল তোর পরিচিত কেউ – এটা বুঝতে পেরে আর ফিরিয়ে দেই নি সেদিন। তাছাড়া আমারও কৌতূহল হচ্ছিলো, দেখি কী কী বই বাছাই করেছিস। জোহান কিছু না বলে চুপচাপ চেকটি নেয়। তারপর উদাস দৃষ্টিতে অন্য সবার কফি খাবার দৃশ্য দেখতে থাকে। এক তরুণ আরেক তরুণীর সাথে ভীষণ খুশিমনে কথা বলছে। খুব সম্ভব প্রেমিক-প্রেমিকা। বোঝাই যাচ্ছে,ছেলেটা তার সঙ্গ উপভোগ করে খুব। জোহান গুনগুন করে –
“Secrets I have held in my heart
Are harder to hide than I thought
Maybe I just wanna be yours
I wanna be yours, I wanna be yours…”
বাড়ি ফেরার পর হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে হোয়াইট মিউজিক ছেড়ে দেই। এটা মূলত মনো:সংযোগ বাড়ানোর জন্য। যখন মাথা একদম ফাঁকা হয়ে যায়,তখন পুরোদমে কাজ শুরু করি। রুমজুড়ে আশ্চর্যরকম নীরবতা। বাইরে থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। এলেও সেটা আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমার পৃথিবীতে এই মুহূর্তে রিসার্চের ডেটা ছাড়া আর কিছুই নেই। এটাকেই হয়তো ট্রান্স স্টেট বলে। কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না। এক মিনিট হতে পারে,আবার এক ঘন্টাও হতে পারে। আমার হুঁশ ফিরলো একটা ফোন কলে। আম্মু ফোন করেছেন।
“হাই মাম্মি! বলো, কী অবস্থা?”
- “হাই আম্মু, তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম নাকি? কী করো?”
“কী যে বলো তুমি! তোমার জন্য আমি সবসময়ই ফ্রী। বলো, কী খবর?”
- “খবর ভালো। তুমি আসবা না?”
“আম্মু,ইদানীং খুব ব্যাস্ত! রিসার্চের কাজ করছি।”
- “আমি জানি,আমার মেয়ে বিজ্ঞানী। আজীবনই সে অনেক ব্যাস্ত।”
“আম্মু, এই রিসার্চটা অন্যগুলোর চেয়ে বেশি সিরিয়াসলি করছি। ইচ্ছে আছে,প্লস ওয়ানে এটা পাবলিশ করার।”
- “সে তুমি কী করো-করো। বিয়ে-শাদির কোনো নামগন্ধ নেই! একটা নাতি-নাতনির মুখ দেখলে শান্তি পেতাম।”
“মা, সকাল সকাল মেজাজ খারাপ করো না,প্লিজ। নাতি-নাতনির এত শখ থাকলে তোমার অন্য ছেলে-মেয়েদের বলো।”
- “তবুও, একজন সাথে থাকলে একা একা লাগতো না।”
“ আম্মু,দিনশেষে সবাইকে একাই থাকতে হয়। চার চারটা সন্তান তোমার। বড় হয়ে এখন কেউ কাছে নেই। বলো,তুমি একা না?”
- “তোমার কোনো কথা শুনবো না। বাসায় আসো। একটা জামাই হলে আমার আর কোনো টেনশন নেই।”
“আম্মু,আমাকে এখন কাজ করতে হবে। টাটা।”
ফোন কেটে দিতেই সময় শো করলো। আটটা বেজে কুড়ি মিনিট। টানা দশ ঘন্টা কাজ করেছি। অফিসে যেতে হবে নয়টার মধ্যেই। ল্যাপটপ বন্ধ করে শাওয়ারে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু এরপরেই একটা নোটিফিকেশন এলো। সুপারভাইজারের ই-মেইল। সারসংক্ষেপ, আজ বিকেলে অফিসে এসো। তার নাকি কী একটা মিটিং আছে। সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিলাম। জানালা দিয়ে অপরাজিতার সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে। এই বাগানটা জোহানের করা। আমি অপরাজিতা পছন্দ করি বলে নিজেই সব করেছে!
গুণগুণ করতে শুরু করলাম –
“ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রী
এখানে থেমোনা
এ বালুচরে আশার তরণী তোমার
যেন বেঁধোনা
আমি শ্রান্ত যে, তবু হাল ধর
আমি রিক্ত যে, সেই সান্তনা,
তব ছিন্ন পালে জয় পতাকা তুলে,
সূর্য তোরণ দাও হানা।”
একমাস পর: শুক্রবার
স্থান: আমার বেডরুম
ছুটির দিন। কিন্তু আমার ছুটি নেই। এমনি দিনে কাজ করি অফিসে,ছুটির দিনে বাসায়। সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি। আমার রিসার্চের কাজ খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। কেন যেন খুবই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডেটা অ্যানালাইসিস করতে করতে জীবন বেরিয়ে যাবার মতো অবস্থা। সাবজেক্টিভ ডেটাকে নিউমেরিকে নিয়ে আসতে এতটা কষ্ট কোনোদিনই করতে হয়নি। বিরক্তিতে জোহানকে ফোন করলাম। এমন ফ্রাস্টেটেড মোমেন্টে আমার সেক্স দরকার।
জোহান এলো। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো- “কী খবর, আনিতা?”
“এইতো চলছে। ম্যাথামেটিশিয়ানের রিসার্চ কেমন যাচ্ছে?”
- “মন্দ নয়। প্রায় হয়ে এসেছে। তোর কী খবর?”
“ভালো নয়। আমার কোনো রিসার্চ করতে এত কষ্ট হয়নি৷ অর্ধমৃত মনে হচ্ছে নিজেকে। ভাবছি,এসব কেন করছি – কী লাভ এসবে।”
- “সবকিছু কি মানুষ লাভের জন্য করে? বত্ব,তোর রিসার্চ টপিক যেন কোনটা?”
“কেমোসোশাল রিয়েলিটি: কীভাবে কেমিকেলের ব্যবহার মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে।”
- “হুম। তোর একটা জিনিস ফেরত দিতে চাই আমি।”
এই কথা বলে একটা খাম বের করলো। খুলতেই বেরিয়ে এলো আমার সাইন করা সেই ব্ল্যাংক চেক। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বললো, “আমি জানি না, কীভাবে বলবো। কিন্তু তোর জন্য উপহার কোনোকিছুর মূল্যমান নয়। এত বড় সোশাল সায়েন্টিস্ট তুই। আর এটা বুঝিস না,আমি তোকে ভালোবাসি। প্রচন্ডমাত্রায় ভালোবাসি।” বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালাম। বললো, “টিনএজার হলে আমি বলতাম,তোকে ছাড়া বাঁচবো না। কিন্তু ম্যাচিওরড আমি – এভাবে বলতে পারছি না। তোর সাথেই থাকতে চাই আজীবন।”
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা… আমিই নীরবতা ভাঙলাম। বললাম, “ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট চাই না আমি। আমার কথা শুনে খারাপ লাগতে পারে তোর। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এসব আবেগিক-শারীরিক জিনিসপাতি সব নিজ জিনকে টিকিয়ে রাখার কৌশল মাত্র।”
“কীভাবে?” – প্রশ্ন করে জোহান।
“ সোজাসাপটা জবাব দে। নারীর কোন কোন জিনিস পুরুষকে আকর্ষণ করে?”
“স্তন, ভারী নিতম্ব, সরু কোমর, পরিষ্কার ত্বক, সুন্দর চুল…”
“এখানেই থেমে যা। একটা একটা করে ব্যাখা করি। স্ফীত স্তন পছন্দ করার কারণ, তার বাচ্চার জন্য পর্যাপ্ত খাবার তার কাছে মজুত আছে। সরু কোমর অর্থ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ইজিলি মুভ করতে পারবে। ভারী নিতম্ব অর্থ,বাচ্চা জন্ম দেয়ার হ্যাসাল সহ্য করতে পারবে। পরিষ্কার ত্বক এবং সুন্দর চুল অর্থ মেয়েটা সুস্থ। দেহে জীবাণুর সংক্রমণ নেই৷ বাচ্চার জন্য পারফেক্ট। আর বাচ্চার প্রশ্ন আসছে কেন? কারণ, বাচ্চাই তোর জিনকে ধারণ করে৷”
আবারো নীরবতা। কেউ ভাঙছে না। বৃষ্টির প্রবল গর্জন অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। অবশেষে জোহানই মুখ খুললো। আস্তে আস্তে বললো,”তুই বড্ড যুক্তিবাদী। কিন্তু আমি কখনোই তোকে সেক্স করার অফার দেইনি। তুই-ই প্রতিবার জোর করেছিস।”
- “কী করবো বল! আমার লিবিডো হাই।”
“তুই অ্যান্টিনাটাল এটাও জানি। বাচ্চা না চাইলে নিবো না। তবুও আমি চাই, তুই আমাকে ভালোবাসিস। একটু আবেগসহকারে বলিস, আমি তোকে ভালোবাসি। এটুকুই চেয়েছি আমি।”
- “আচ্ছা, দেখি তো,, সেক্স চাস কি না তুই…”
ওকে সজোরে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই। তারপর ঠোঁটে তীব্র কামড় দিয়ে বলি – “বি গুড।” যন্ত্রণার ছাপ ফুটে ওঠে ওর চোখে-মুখে। তারপর নরম হই। আস্তে আস্তে চুম্বন করি। অর্গাজমের শেষ আর্তনাদটুকু যখন মিলিয়ে গেল,ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। জানালা দিয়ে অপরাজিতার উজ্জ্বল সতেজ পাতা দেখা যাচ্ছে।
দেড় বছর পর:
স্থান: আমার বাড়ি
সবাই এসেছে। বাবা-মা,ভাই-বোন,জোহান, শীতল,আমার সুপারভাইজার, কলিগ, বন্ধুবান্ধব সবাই। আমি কাউকে আসতে বলিনি। জোহানই আমার সুপারভাইজারকে বলে এতসব করেছে। উপলক্ষ্য, প্লস ওয়ানে আমার পেপার পাবলিশ হয়েছে। আমি নাকি এখন দেশসেরা রিসার্চারদের একজন। কিন্তু টু বি অনেস্ট, আমার কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমি এর যোগ্য নই। যেমনটা হয়েছিলো ঢাবিতে চান্স পাবার পর। মনে হয়েছে, আমি এর অযোগ্য। জীবন আমাকে দয়া করে এতবড় উপহার দিয়েছে৷
প্রিয় পাঠক,আপনিও আমার বাড়িটা ঘুরে আসুন। বেশ ভালো লাগবে আপনার। এমনি দিনে নীরব থাকে। কিন্তু আজ একটা উৎসবের আমেজ রয়েছে। সাজসাজ ভাব। সবকিছুই সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বেলুন,কেক,রংবেরঙের লাইটসহ আরো হাবিজাবি সব জিনিস আনা হয়েছে৷ আমার নির্লিপ্ত ভাব দেখে সুপারভাইজার জিজ্ঞাসা করলো – “হেই মাই চাইল্ড, তুমি খুশি হওনি?” বললাম,”হ্যাঁ, হবো না কেন? এতো অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার।” সুপারভাইজার চোখ টিপে বললেন, “ইউ মাস্ট বি লাকি। ইউ হ্যাভ আ জোহান।” আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম, “আম্মু আপনাকে কিছু বলেছে নাকি! জোহান শুধুই আমার ভালো বন্ধু।” উনি হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার অস্বস্তি লাগছিলো। বললেন, “এখন ভালো বন্ধু পরে ভালো হাজবেন্ড হবে। খারাপ কী?” আমি চুপচাপ সরে এলাম ওখান থেকে৷ শরীরি ভাষায় বুঝিয়ে দিলাম, এসব আলাপ আমার পছন্দ নয়। যদিও জানি,এই আলাপ আরো অনেক সহ্য করতে হবে।
আম্মুর সাথে জোহানের বেশ ভাব হয়ে গেছে। বেশ মনোযোগী শ্রোতা সে। আম্মুর সব কথা যেন সে গিলে গিলে খাচ্ছে। কে জানে,হয়তো বলছে, আমার মেয়েটা একটু পাগল। তুমি যদি ওকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে যদি ঠিক করতে… ঠিক করা মানে, বিয়ে – সেটা জোহান নিশ্চয়ই বুঝবে। বাকি সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সবাই আনন্দে মত্ত। আমি চুপচাপ অপরাজিতা গাছ দেখতে লাগলাম। নীলাভ কলি এসেছে। ফুল ফুটবে কিছুদিনের মধ্যেই। শূন্য দৃষ্টিতে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক গানটার মতো অনুভূতি –
“In the end,It doesn’t even matter… “
এক সপ্তাহ পর: শেষ রাত
জোহানের সাথে ছাদে এসেছি। টেলিস্কোপ সেট করা। এই টেলিস্কোপটি আম্মু গিফট করেছে। টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে তারাদের রাজ্য দেখায় যে কী আনন্দ সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। জোহান আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। তারা দেখার ফাঁকে ফাঁকে ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি। ওকে নিষ্পাপ শিশুর মতো লাগছে। ও বললো, “তুই কি আমার হতে পারিস না?” বিলি কেটে দিতে দিতেই বললাম, “আমি কি তোর নই? এখনো তো আমার সাথেই আছিস।”
“তুই জানিস, আমি কী বোঝাতে চেয়েছি। কেন তোর প্রেমিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারি না আমি? কী কমতি আছে আমার?”
- “নিজেকে এসব ভেবে কেন কষ্ট দিস? জানিসই তো,আবেগ আমাকে স্পর্শ করে না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে বুদ্ধিমান, গুণবান,আদর্শ পুরুষকেও আমি প্রত্যাখ্যান করবো।”
“তাহলে ইউজেনিক্সও তোর পাত্তা পাবে না। আর আমি কোন ক্ষেতের মূলা!”
- “তুই ইউজেনিক্স এর চেয়ে কম কী? আমার সারাজীবনে এত অসাধারণ ছেলে দেখিনি।”
“তাহলে সমস্যা কোথায়?”
- “সমস্যা হচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশে একটা ছোট্ট অঙ্গাণু থাকে। বাদামের মতো। তার নাম অ্যামিগডালা। ক্রিটিক্যাল থিংকিং করায় এই অংশ। লাভ হরমোন অ্যামিগডালার কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যুক্তি-বুদ্ধি লোপ পায়। আমি একজন রিসার্চার। ক্রিটিক্যাল থিংকিং অ্যাবিলিটি আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।”
“কিন্তু আমিও তো একজন গণিতবিদ।”
- “হ্যাঁ, তোর মাথায় এসব ভূত না এলে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এতদিনে ফিল্ডস মেডেল পেয়ে যেতি।
এখন দেখ তো, কালপুরুষের পাশের তারাটা কী? নতুন মনে হচ্ছে। চিনতে পারছি না।”
রজনীর পালা শেষ। তারাগুলো ক্রমশই বিদায় নিচ্ছে সূর্যের আলোকসম্ভারীতে। ছাদেও অপরাজিতার জয়জয়কার। গাঢ় নীল রঙ হুটোপুটি খাচ্ছে ছাদজুড়ে। আমি কখনো এত অপরাজিতা একসাথে দেখিনি। নীলের অপূর্ব সমাহার। জোহান অপরাজিতার একটা ফুল ছিঁড়ে আমার কানে গুঁজে দেয়। কপালে স্নিগ্ধ চুম্বন করে বলে – “তুই যেটুকু অধিকার দিয়েছিস,এই বা-কম কীসে!” গুণগুণ করে গাইতে শুরু করলো –
“ওহে কী করিলে বলো পাইবো তোমারে
রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাবো না
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কি বা তোমারে
দয়া না করিলে কে পারে
তুমি আপনি না এলে কে পারে
হৃদয়ে রাখিতে…”
সাইরেনের ন্যায় কন্ঠস্বর জোহানের। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওকে ঠিক পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না – স্বর্গীয় কোনো দূত হলেও হতে পারে। মনে হচ্ছে, গোটা একটা জীবন ওর মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয়া যাবে…
লেখিকা : সিরাজাম মনিরা শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- অপরাজিতা
সিরাজাম মনিরা
- জুলাই ৩০, ২০২৪ - অন্য পৃথিবীর গল্প
রোদ্দুর
- মার্চ ২২, ২০২৪ - ইদানীং
মাসুদ করিম
- ডিসেম্বর ৭, ২০২৩
Korsan yazılım indirme SEO optimizasyonu ile web sitemiz daha fazla ziyaretçi çekmeye başladı. https://royalelektrik.com/istanbul-elektrikci
Keep up the fantastic work!
Joint Genesis Reviews, Pricing, and bonuses visit here: joint genesis
Joint Genesis Reviews, Pricing, and bonuses visit here: joint genesis
Joint Genesis Reviews, Pricing, and bonuses visit here: joint genesis
What is a good dental health? My website: prodentim reviews