আমাদের বউ । গল্প। আসাদ প্লাবন।

কেমিস্ট্রিতে ফার্স্টক্লাস পাওয়া ছেলেটাও বউয়ের মন বোঝে না l অথচ ছাত্র জীবনে কতো জটিল সব রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমাধান করে ফেলেছে l সত্যিই তাই l জিওগ্রাফি, ফিলোসফি, বায়োলজি সব বোঝা যায়, শুধু স্ত্রীলোকের মন বোঝা কোনো পুরুষ মানুষের সাধ্য নয় l আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, একান্তই বিয়ে করতে হলে একটা কলাগাছকে করো, তবু কোনো মেয়েকে নয় !সেদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে বসেছি l নীলা চায়ের কাপ নিয়ে পাশে বসলো l বলতে শুরু করলো : ” পাশের বাসার ফারিয়া ভাবী, মানে গতমাসে যারা নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে এসেছে আর কি … আজ বিকেলে আমাদের বাসায় এসেছিলো l বেশ মিশুক আর হাসিখুশি l কি লম্বা সিল্কি চুল ! চোখদুটোও বেশ l আর কথা বলার ধরণটা খুব সুন্দর l “

— ” ও ফারিয়া ভাবীকে চিনিতো l তার দীঘল কালো চুলে ঢেউ খেলে যায় l ভীষণ রোম্যান্টিক l “

বউ রাগে গজগজ করছে l বেশ বুঝতে পারছি, অতি আগ্রহ দেখানোটাই ভুল হয়েছে আমার l সে বললো,

‘ তুমি কিভাবে এতোকিছু বুঝতে পারলে ? ‘
লেখক : আসাদ প্লাবন

আমতা-আমতা করে আমি বললাম, ‘ না মানে, সেদিন অফিস যাওয়ার সময় বললো তার ছেলেকে একটু স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যেতে l খুব মিষ্টি গলার স্বর l ‘

এবার সে বলছে, ‘ তাইতো বলি বারান্দায় বসেই এদিক-ওদিক এতো তাকানো কিসের ! নিজের ছেলেকে পড়া দেখিয়ে দিতে বললে তোমার তখন সময় হয় না, আর পরস্ত্রীর সন্তানের জন্য তুমি জান দিয়ে দাও ! যেভাবে আছো, সেভাবেই বের হয়ে যাবে বাসা থেকে l সারা রাত বাইরে থাকবে l
এটাই তোমার শাস্তি l ‘

আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘ আশ্চর্য, এর কোনো মানে হয় ? আর আমি জীবন দিয়ে দিলাম কখন ? ‘

সন্ধ্যা থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে l জ্যৈষ্ঠ মাস, তবু শীতে কাঁপছি আমি l ক্ষিধেয় পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে l টাকা নিয়ে আসতে পারিনি সাথে l পকেটে হাত দিয়ে লাইটার আর দুটো সিগারেট পেলাম l সেখান থেকেই একটা ধরালাম l হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পাশেই একটা কুকুর ঘুরঘুর করছে l আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ভাই একা কেন তুই ? তোকেও কি তোর বউ বাসা থেকে বের করে দিয়েছে নাকি ? ‘
— ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ l ঘেউ, ঘেউ l ‘
( মাইয়া মানুষ বড়ই আজিব ভাইজান l যতোই বুঝতে যাইবেন, ততোই ধাক্কা খাইবেন আপনে l মাইয়া মাইনষের জন্য আপনের কইলজা কাইটা রাইন্ধা দিলেও কইবো লবন কম হইছে ) !

হঠাৎ পেছন থেকে ঘাড়ের ওপর হাতের ছোঁয়া পেলাম … ” ভাই, আমার নাম মেহেদী l প্রচন্ড সিগারেটের নেশা জাগছে l সিগারেট ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারি না আমি l কিন্তু আসার সময় সিগারেট সাথে নিতে পারিনাই l “

— ” ও, আপনারও তাহলে একই কেস l অতিরিক্ত সিগারেটের কারণেই কি তাহলে ভাবীজান নাখোশ হয়ে এমন কঠিন অ্যাকশন নিয়েছে ? ”
এবার সে বললো, ‘ ঘটনা তা নয় l গতকাল অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর বউ বললো, দ্যাখো একটা নতুন পারফিউম কিনেছি আজ l কেমন হয়েছে বলোতো l আমি একটু স্প্রে করে তাকে বললাম, ভালোই l তবে আমাদের অফিসের মনিকার’টা একটু বেশি ভালো l “

ব্যস শুরু হয়ে গেলো :’ মনিকার ‘ টা মানে কি ? পারফিউম নাকি অন্যকিছু ? তাইতো বলি, বাসায় পারফিউম দিস না তুই, কিন্তু তোর কাপড় থেকে পারফিউমের ঘ্রাণ কোথা থেকে আসে প্রতিদিন ? এই মুহূর্তে বাসা থেকে বের হ তুই l সারা রাত গেট এর কাছে দাঁড়িয়ে থাকবি l ‘

এক মনে বলে চলে মেহেদী : ‘ ইয়ারমেট বিয়ে করার এই এক জ্বালা l তারা তুই-তোকারি ছাড়া কথা বলতে পারে না l স্বামী’র সাথে তুই-তোকারি করিস ! জাহান্নামে কি তুই যাবি, নাকি আমি যাবো ? ‘

দৃশ্যপটে তখন আগমন এক মধ্যবয়েসী ভদ্রলোকের l কাঁচা-পাঁকা চুল, বয়স পঞ্চাশের মতো l লেফট-রাইট করতে করতে উনি আসলেন l কাছে এসে বললেন, ‘ তোমরা এখানে কি করছো এতো রাতে ? ও বুঝেছি l তোমরাও আমার মতো হতভাগা l মানে, বউ কতৃক বিতাড়িত …হা হা হা ! আমার নাম মোমিন শিকদার l অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা l কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঘরে আমার কোনো কমান্ড নেই l যখন-তখন উনি অর্ডিন্যান্স জারি করে বসে থাকেন l এইযে দ্যাখো, লুঙ্গি পড়েই চলে আসতে হয়েছে l প্যান্টটা পর্যন্ত পড়ার সময় দেয়নি l
আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কি হয়েছিলো ভাই ? ‘
— ‘ আজ ছিলো আমাদের কুড়িতম বিবাহ বার্ষিকী l লিপস্টিক, চুড়ি, একগাদা গয়না পড়ে উনি খুব করে সাজলেন l একমাত্র ছেলে দেশের বাইরে পড়াশোনা করে l তো উনি বললেন, তাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতে হবে l আমি শুধু বলেছিলাম, এই বৃদ্ধ বয়সে এইসব রোম্যান্স ঠিক মানায় না, শায়লা l ব্যস শুরু হয়ে গেলো তার সামরিক শাসন !
— ” কি বললে ? আমি বুড়ি হয়ে গেছি ? রাস্তায় চলতে গেলে এই কারণেই বুঝি ঘাড় ঘুরিয়ে কঁচিকঁচি মেয়েদের দ্যাখো তুমি ! আমাকে বললেই তো হয় l একটা যুবতী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দিই তোমাকে l অনেকদিন ভালো-মন্দ কিছু খাই না !
আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনবো l এর মধ্যেই বাসা ত্যাগ করবে তুমি l তোমার এই অভিশপ্ত মুখ আমি দেখতে চাই না ! “

আমরা বেশ বুঝতে পারলাম, উনার অবস্থা আমাদের থেকেও শোচনীয় l খানিক পরেই টুপি মাথায় দেয়া এক দাঁড়িওয়ালা হুজুর আসলেন l এসেই বিরাট করে এক সালাম দিয়ে বলা শুরু করলেন : ‘ আমি আব্দুস সালাম মাইজভাণ্ডারী l মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমাম l হাজার-হাজার মানুষ আমার বয়ান শুনে সু-পথে চলে আসে, অথচ আমার বিবিকে বশ মানাতে পারি না আমি l ক্ষমা করো, ইয়া আল্লাহ l অবশ্য, আপনারাও যে আমার মতো একই পথের পথিক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না l তাইলে শোনেন আমার ঘটনা : আমার বিবি বাইরে বিশাল পর্দানশীল l কিন্তু ঘরে নাকি তার পর্দা করার দরকার হয় না l রাতে ঘুমানোর সময় যখন দেখলাম, তার পরনে ছোট কাপড়, আমি বললাম, বিবি বাইরে যেমন পর্দার প্রয়োজন, ঘরেও ঠিক তেমনই প্রয়োজন l আপনে যদি ভাবেন কেউ তো দেখতেছে না আমারে, তাইলে ভুল ভাবতেছেন l আল্লাহ কিন্তু ঠিকই নজর রাখতেছেন সবকিছু l ‘

তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো আমার বিবি, বলা মাত্রই — ” আপনের কি অসুবিধা আমি ঠিক বুঝলাম না l আমি ল্যাংটা হইয়া থাকলেও তো আপনে চাইয়া দেখেন না l আপনের না হয় যৌবন শেষ হইয়া গেছে, কিন্তু আমার তো শখ-আহ্লাদ এখনও মরে নাই l আপনের মুখে এইসব বড়-বড় বুলি মানায় না l আপনের চাইতে কতো বড় আলেম লোক দেখলাম, তারা আপনের মতো এমন নিরস না l আপনের এই ঘরে থাইকা কোনো কাম নাই l আপনে এই মুহূর্তে চইলা যান, আল্লার কসম লাগে ! “

শুনলেন তো মিয়ারা, এই হইলো আমার ঘটনা l তবে একটা কথা কি জানেন, মেয়েলোক পুরাপুরি ভালো আসলে পাওয়া যাবে না l কিছু সমস্যা থাকবেই l পুরুষের বাম পাঁজরের হাঁড় থেকে মহিলাদের তৈরী করেছেন আল্লাহ্পাক রাব্বুল আলামিন l তাই তারা হাঁড়ের মতোই ত্যাড়া l সব চাইতে ভালো হয় তাদের সাথে বিবাদে না জড়িয়ে ভালোবাসা দিয়ে তাদের বশে রাখা l তবে সবসময় যে আপনি জিতবেন তা কিন্তু নয়, কিছু ব্যতিক্রম তো থাকবেই l চলেন মিয়ারা, ফজরের আজান পড়তেছে l মসজিদে গিয়া জামাতের সাথে নামাজটা পড়ে নিই আমরা l তারপর যার-যার ঘরের দিকে রওয়ানা হই l পুরুষ মানুষকে কষ্ট দিয়ে ঘরের বউ কিংবা নারীরাও যে ভালো থাকে তা নয় l গিয়ে দেখবেন, সবাই সারা রাত ধরে জেগে ছিলো l আমাদের চিন্তায় উনারাও ঘুমাতে পারেনাই l মেয়ে মানুষ হইলো আল্লাহর অশেষ নিয়ামত, বলেন সুবহানাল্লাহ l এক একটা সংসারের প্রাণ ভোমরা এই মহিলাগণ l আল্লাহর নাম নিয়া চলেন এইবার মসজিদের দিকে যাই l

সত্যিই দেখা গেলো, কোনো ঘরের স্ত্রী-ই রাতে ঘুমায়নি l নীলার প্রেসার অনেক বেড়ে গেছে l সারা রাত ছটফট করেছে l সকালে বাসায় গিয়েই তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে l মেহেদী বাসায় গিয়ে শতাব্দীর সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে l তার স্ত্রী রাতেই মার্কেটে গিয়ে গুনে-গুনে তার জন্য একশো একটা পারফিউম কিনে এনেছে l সে-কি কান্না তার ! আর্মি অফিসারের স্ত্রী গেটেই দাঁড়িয়ে ছিলো l দেখা হতেই আমতা-আমতা করে বলেছে, তুমি ভেবেছো তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি আমি l মোটেও না l শরীরটা মোটা হয়ে যাচ্ছে, তাই ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করি l ভেতরে যাও, আমি আসছি l
আর হুজুরের স্ত্রী সেই থেকে এমন পর্দানশীল হয়েছে যে, পারলে গোসলের সময়ও বোরকা আর হিজাব পড়েই গোসল করে !
——————————————
লেখক : আসাদ প্লাবন । একজন কবি।
ড্রিমমেকার অনলাইন ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *