আসছে কাদের সিদ্দিকীর মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র ‘বঙ্গবীর’

আমি তখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি, থাকতাম আব্বুর চাকুরিস্থল মির্জাপুর উপজেলার গোড়াইর একটি সরকারি কোয়াটারে। গ্রামে থাকার সময় সবার সাথে যেমন গোলাগোলি খেলতাম, তেমনি গোড়াই এর বাসায়ও মাঝে মাঝে পিছনে স্কুল ব্যাগ নিয়ে বড় একটা কাঠের স্কেলকে বন্দুক বানিয়ে গোলাগোলি খেলতাম একা একাই। এ খেলার নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধ। বিছানার বালিশ গুলোকে পাকিস্থানী মিলেটারি ভেবে মুখে ঠা ঠা দ্রিম দ্রিম আওয়াজ করতাম, আর বিছানার উপর হামাগুড়ি দিয়ে এপাশ থেকে খুব সতর্কতার সাথে ওপাশে যেতাম যাতে বালিশ হানাদার বাহিনী দেখতে না পায়।

একদিন আব্বু বললেন- ‘সোহাগ পাড়া স্কুলের মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী আসবেন, চল দেখতে যাই’। আমি তো চরম উত্তেজিত, প্রতি ক্লাসে বীর শ্রেষ্ঠদের যে কাহিনী থাকতো তার বেশির ভাগ গদ্য আমার মুখস্থ থাকতো; বিশেষ করে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানেরটা তো ঠোটস্থ ছিল, সেরকম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে চাক্ষুস দেখতে পাওয়ার উত্তেজনা আমার কাছে যে কী রকম ছিল তা বলে বোঝানো যাবেনা!

সোহাগ পাড়া স্কুল মাঠে যেদিন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আসলেন, সেদিন সে স্কুল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ । যাতে আমি কাছ থেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে দেখতে পাই সে জন্য আব্বু আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকে যেতে বলল, আর আমার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখলেন, আমার সমবয়সী আরও অনেকেই ছিল যারা কাদের সিদ্দিকীকে দেখতে এসেছিল, আমার স্কুলেরও কেউ কেউ ছিল। জনসমুদ্ররের ফাক ফোকর দিয়ে আমি ক্রমেই সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম, কিন্তু এক সময় এক স্বেচ্ছাসেবক আমার গতি রোধ করলেন, বললেন আর সামনে যাওয়া যাবেনা।

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সেই জন কোলাহলের মাঝেও ব্যাপারটি খেয়াল করলেন, তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে সেই সেচ্ছাসেবককে বললেন- ‘এই তুমি ওকে থামাচ্ছো কেন? ওকে সামনে আসতে দাও, আর সব শিশু কিশোরদের আমার সামনে বসাও, ওরাই আমার কাছে বেশি গুরত্বপূর্ণ’। বঙ্গবীরের ঘোষণা শুনে সব শিশুকিশোর একদম মঞ্চের সামনে বসার জায়গা পেল আর বঙ্গবীর সব শিশু- কিশোরদের সাথে হ্যান্ডসেক করলেন সাথে একটা করে চকলেট দিলেন। বঙ্গবীরের খসখসে দৃপ্ত সেই হাত যখন আমি স্পর্শ করলাম তখন আমার দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল, আমি প্রচণ্ড শিহরীত হলাম এই ভেবে যে, এই হাতে তিনি স্টেনগান কিংবা কাটা রাইফেল নিয়ে সত্যি সত্যি যুদ্ধ করেছিলেন, যে রকম আমি বালিশদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ খেলে গুলি করি, সে সত্যি সত্যি গুলি করে হানাদারদের কূপকাত করেছিলেন। সে রাতে আমি কয়েকবার মুক্তিযুদ্ধ খেলেছিলাম।  ঠা ঠা দ্রিম দ্রিম  ।  

মাসুদ করিম

অনেকদিন পর, তখন আমি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র। টাঙ্গাইল ফুলকির উদ্যোগে ব্রতচারী ক্যাম্পে অংশগ্রহন করেছিলাম গালা ইউনিয়নের একটি ট্রেনিং সেন্টারে। সেই ট্রেনিং সেন্টারে কবি বুলবুল খান মাহবুব আসলেন লেকচার দিতে, তিনিও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা । কবি বুলবুল খান মাহবুব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনাচ্ছিলেন, বিভিন্ন অপারেশন এর কথা বলছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিন হয়তো কারো টি-শার্ট দেখে বলতে লাগলেন , তোমরা চে গুয়েভারার ছবি অঙ্কিত টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়াও অথচ তোমরা জানোনা আমাদের বাংলাদেশের চেগুয়েভারা হলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তোমরা যদি ঠিকমতো জানতে তাহলে তোমরা উনার ছবিও টি-শার্ট-এ ধারন করতে। কবি বুলবুল খান মাহবুব কাদের সিদ্দিকির সাথে  মুক্তিযুদ্ধ কালীন ঘটনা বলতে লাগলেন আর আমরা গিলতে লাগলাম।

সেই ব্রতচারী ক্যাম্পে একদিন আসলেন ভাষা সৈনিক কামাল লোহানী , যিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালকও ছিলেন। কামাল লোহানী বেশ কয়েকদিন ক্যাম্পে থেকে আমাদের সাথে অনেক গল্প করলেন। তিনি যেদিন চলে যাবেন, সে দিন ক্যাম্প কমাণ্ডার আমিনুল হক কায়সার ভাইয়া আমাকে বলেলন, ‘মাসুদ তুমি কামাল লোহানী ভাইকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসো’। আমাকে ব্রতচারী ক্যাম্পের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দিয়েছেলন কায়সার ভাই।

খুব সকালে  ব্রতচারী ক্যাম্পের সাদা টয়োটা নিয়ে কামাল লোহানী ভাই এর সাথে রওয়ানা দিলাম টাঙ্গাইল ট্রেন স্টেশনের দিকে , কামাল লোহানী ভাই আমার সাথে গল্প শুরু করে দিলেন, তার কথা প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল এর বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বঙ্গবন্ধুর নিকট অস্ত্র সমর্পন এর দিনের কথা উঠে আসলো। বাংলাদেশ বেতারে সেই অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের জন্য তিনি নিজেও এসেছিলেন সে অনুষ্ঠানে। আমি গোগ্রাসে তার সব কথা শুনছিলাম। কামাল লোহানী ভাই এক সময় কিছুটা দুঃখের সাথে বললেন- ‘বঙ্গবীর কিন্তু আমাদের বেতার এর একটি ট্রান্সমিটার আজোও ফেরৎ দেয় নি’। আমি জিজ্ঞাস করলাম কেন? লোহানী ভাই বললেন, ‘আমার মনে হয় কাদের সিদ্দিকী ভেবেছিলেন যদি কখনো টাঙ্গাইলকে স্বাধীন করার দরকার পরে তাহলে তিনি ওই ট্রান্সমিটারটা ব্যবহার করবেন’। লোহনী ভাই এর কথা শুনে আমার বুকের ছাতি ফুলতে লাগলো । কামাল লোহানী ভাই আমার মতো তুচ্ছ এক তরুণকে খুব গুরুত্ব দিয়ে অনেক কথা মনোযোগ দিয়ে বলতে গিয়ে সেদিন তার প্রথম ট্রেনটা মিস করেছিলেন। ট্রেন যে কখন আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল বুঝতেই পারিনি, এ নিয়ে অবশ্য অনেক হাসাহাসি হয়েছিল। 

আমি টাঙ্গাইলের ছেলে হওয়াতে আরো কয়েকবার বঙ্গবীর এর ভাষণ শুনতে পেরেছি, কিংবা কখনোও কখনোও অড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের গল্পে বঙ্গবীরের বীরত্বগাঁথা আবিষ্কার করে করে অবাক হয়েছি । বঙ্গবীর মুক্তিযুদ্ধের এমন একজন নায়ক যার সাথে হ্যাণ্ডসেক করার জন্য জেনারেল নিয়াজী হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী নিয়াজীর সেই রক্তাত্ত হাত কে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, অথচ জেনারেল নিয়াজীকে প্রত্যাখ্যান করা তার হস্তদয় শৈশবে আমাকে বাড়িয়ে দিয়েছেলেন চকলেটা সহ। এ এক অনন্য অনুভূতি। 

উপরের সমস্ত কথাই আজ নাট্য নির্মাতা ও গল্পকার ফরিদ উদ্দিন মোহাম্মদ এবং নির্মাতা মামুন খানের সাথে শেয়ার করলাম গুলশানে একটি মিটিং-এ বসে। পাশের দেশেই তাদের যে কোন সেক্টরের হিরোদের  নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলে, অথচ আমরা এই জীবন্ত কিংবদন্তী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন মুভি বা নাটক নির্মাণ করতে পারিনি বা করিনি, যা হওয়া খুব দরকার। আর বঙ্গবীর এর বায়োপিক একটি জাতীয় সম্পদ হওয়ার কথা।

মামুন খান

নাট্যকার ও পরিচালক – মামুন খান পুরো বিষয়টি শুনে আবেগী হয়ে পরেন। মামুন খানের  পিতা – মো ইদ্রিস আলী (মৃত) ১১ নাম্বর  সেক্টর এর একজন  বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মামুন খানও বলতে থাকে, আমরা টুপি দাড়িওয়ালা রাজাকার আর মিলেটারি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দুঃখময় প্লট নিয়ে অনেক নাটক নির্মাণ করে ফেলেছি, অথচ আমাদের টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তীকে নিয়ে সত্য কাহিনী নির্ভর কোন কিছু নির্মাণ করতে পারিনি, যা করা আসলেই খুব গুরত্বপূর্ণ ।

ফরিদ উদ্দিন মোহাম্মদ

নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার ফরিদ উদ্দিন মোহাম্মদ, সম্প্রতি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রক্ষাপটে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’কে চিত্রনাট্যে রূপদান করেছেন। যা সম্প্রতি সরকারী অনুদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছে । তাছাড়া তিনি প্রিতীলতা ওয়াদ্দেদারের উপর নির্মিতব্য বায়োপিক এই চলচ্চিত্রের প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। ফরিদ উদ্দিন মোহাম্মদ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে চলচ্চিত্র “বঙ্গবীর” এর চিত্রনাট্য তৈরীর প্রাথমিক ধাপের কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

বঙ্গবীর বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকীর রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা মতাদর্শ নিয়ে অনেকের মনে বিতর্ক থাকতে পারে, কিংবা আরো অনেক কারণে অনেকের মনে বঙ্গবীর প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির ভুমিকা  সূূর্যের  মতো দীপ্তিময়, বজ্রের মতো বীরত্বময় এবং প্রশ্নাতীত । 
বঙ্গবীর শরীরবয়সে খুববেশি দুর্বল হবার আগেই আমরা এই জীবন্ত কিংবদন্তীকে নিয়ে আরেক বার টাঙ্গাইলের রনাঙ্গন চষে বেড়াতে চাই। নির্মাণ করতে চাই বিরত্বগাঁথা বিশ্বমানের এক অভাবনিয় বায়োপিক চলচ্চিত্র । পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর আতঙ্ক টাইগার সিদ্দিকীকে তার অতুলনীয় রূপে তুলে ধরতে চাই সবার সামনে – বায়োপিক বঙ্গবীর।  

লেখক: মাসুদ করিম।

ইতিমধ্যেই বঙ্গবীরকে নিয়ে গবেষণার কাজ  শুরু হয়েছে,  স্ক্রিপ্টিং  এর পর স্পেশাল ইফেক্ট নিয়ে করা হবে বিস্তর  পরিকল্পনা ।  বঙ্গবীর বায়োপিক প্রোজেক্টের ব্যাপারে  আগ্রহী প্রডিউসার, স্পন্সর ও অনুদান প্রদানে আগ্রহি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন চলচ্চিত্রটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ড্রিম মেকার ক্রিয়েটিভ স্টেশন’।  

বঙ্গবীর চলচ্চিত্র নির্মান টিমের সাথে যোগাযোগ- ০১৪০৯৩৫০৮৫৮, ০১৭৮০৩৭৯৪৯৬, ০১৬৮০১৮৫৫৫৮ । ইমেইলঃ dreamakerbd@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *