ভাবনার হালখাতা ২০২৪

মাসুদ করিম

দেহ জয় করতে গেলে মনের কম পড়ে, আবার মন জয় করতে গেলে দেহের কম পড়ে। বছরের পর বছর শেষ হতে হতে আরেকটা বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে, আবার আরেকটা বছর শুরু হচ্ছে। তাই ভাবতে বসলাম—ভাবনার হালখাতা।

চারপাশে এতো তথ্যের ভিড়ে, মোবাইলে দেখতে থাকা অসংখ্য রিলের ভিড়ে, মানুষের ভিড়ে, জীবিকার ভিড়ে, ক্ষয় হতে থাকা সম্পর্কের ভিড়ে আমি কতটুকু বেঁচে থাকলাম? এই প্রশ্নের উত্তর বের করে কিভাবে আমি বেঁচে থাকতে চাই নতুন বছরে—এটার একটা হ্যাস্ত-ন্যাস্ত করা দরকার। ফলনার মা বলে,”তুমি একটা তরমুজের দোকান দাও। জুস খাইবা আর বেচবা।”

একসময় ঠিক করেছিলাম, আমিও গল্প লিখব। পরে ঠিক করলাম গল্প না লিখে গল্পের নায়ক হব, আমাকে নিয়ে অন্যরা লিখবে। বাদ দিলাম গল্প লেখা। অল্প পরিশ্রমে কবিতা লেখা যায় বলে কিছু কবিতা লিখলাম। দেখলাম, কবিতায় বিপ্লব হয় না। কবিতায় যে মৃদু প্রেম হয়, তা আবার জীবনের ধাক্কায় শেষ হয়ে যায়। তাই কবিতাও বাদ।( বিয়ের পর মনে হয় কবিতা লেখা হুমকিতে পড়লো!)

নানান জীবিকায় নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে ভাবলাম স্টিভ জবসের কথা। সব ডট-এর একটা কানেকটিভিটি আছে। তাই আমি ভাবতে থাকি—ঐ বিন্দুবাসিনী স্কুল তৈরি হয়েছিল আমি পড়ব বলে। আমি পড়ব বলে টাঙ্গাইলে শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। টাঙ্গাইলে আনন্দপাঠ, ফুলকি হয়েছিল সব আমার জন্য। কম্পিউটার আবিষ্কার হয়েছে, ইন্টারনেট এসেছে আমি ব্যবহার করব বলে। মেট্রোরেল হয়েছে আমি চড়ব বলে। সেদিনের সে বিপ্লব হয়েছিল আমার জন্য। আমি আসার পর পৃথিবীর সব আয়োজন আমার জন্য। এই শতাব্দী আমার। এমনকি তুমিও আমার, যে এই লেখা পড়ছ।

আমার বন্ধুরা নিজেদের বয়স্ক বা বুড়া দাবি করে যখন আলাপ করে, আমি মনে মনে ভাবি, “হালায় কয় কি! আমি তো এখনো নবীন রয়ে গেলাম। আসল ইনিংস শুরুই করলাম না।” ভাবি, আমার হালকা বুদ্ধি থাকলেও চালাক হতে পারিনি। চালাক হলে বৈষয়িক অনেক কিছু হয়তো হতে পারত এতোদিনে।

যে প্রশ্নগুলো জীবনকে কনফিউজড করে ফেলে, সেই প্রশ্নগুলোর বেশিরভাগ উত্তর আমার জানা। তারপরও মনে হয় কেন জানি কনফিউজড থাকি। মনে হয় কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি বর্ণ, শব্দ, রং, আলো নিয়ে ইচ্ছামতো খেলতে পারি। যা ভাবি, তাকে এক পলকে বাস্তবে নামিয়ে আনতে পারি। তবুও কেন জানি খেলায় পিছিয়ে রইলাম। সব খেলাই খেলতে গেছি বলে এমনটা হতে পারে। তবে ভাবতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই আইনস্টাইন যখন বলেছিল, “জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা দরকারি,” কথাটা শুনে মনে হলো, সে বুঝি আমাকেই বোঝাচ্ছে।

দারুণ মোটিভেশন নিয়ে যখনই ঠিক করি—আমিও পৃথিবী কাঁপিয়ে দেব কিছু একটা করে, তখনই আমার ঠান্ডা-কাশি লাগে। আমার ভিতরের বিশাল বাঘ বিড়ালের মতো হয়ে মিউ মিউ করতে থাকে। আমি শুয়ে থাকি আর ভাবি।

কত মানুষ দূর থেকে কাছে এসেছে, আবার কত মানুষ দূরে সরে গেছে। আমিও কত মানুষের কাছে গেছি, আবার দূরে চলে এসেছি। এভাবে ভাবতে গেলে শেষ পর্যন্ত আমার গ্রামে থাকা নানির কথা মনে হয়। যারকাছে আমার নিরাপদ রঙ্গীন শৈশব কেটেছে। গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমায় ম্যাক্সিমাস মারা যাওয়ার সময় যেমন এক বিস্তীর্ণ সোনালি গমক্ষেতের পরশের দৃশ্য দেখে, আমার মৃত্যুর সময় হয়তো নানির সাথে থাকা কোনো এক দৃশ্য মনে করব। মনে করব আকাশভরা জোছনা রাতে, উঠানে পাটি বিছিয়ে নানি গল্প বলছেন, আর টুকরিতে ছোট ছোট করে কাটা আখের দানা খেতে খেতে সেই গল্প শুনছি।

আমি আর কতদিন বাঁচব? এটা ভাবতে ভাবতে ভাবি—আমি কত বছর বাঁচতে চাই? কত সালে মারা যেতে চাই? ভেবে দেখলাম, আমি ৯৯ বছর বাঁচতে চাই। এখনো অনেক দিন বাঁচতে হবে। বাঁচার মতো বাঁচতে হবে, নাকি নিজের মতো বাঁচতে হবে—এটা আবার এক ভাবনার বিষয়!

২০২৪, তারাতারি বিদায় হও। ২০২৫, তারাতারি এসো। তোমাকে দিয়াই পৃথিবী কাপাইয়া দেবার বছর শুরু করতে হবে ।। ( খুক খুক,ইয়া হেইচ্চো । )

লেখক : মাসুদ করিম ।

ড্রিমমেকার অনলাইন ম্যাগাজিন