ছায়া মায়া

সার্মন মৌরী

পায়ে জুতো নেই, হাঁটু অব্দি কাদা, আর গাড়ির পেছন ভর্তি টাটকা লাউ, কুমড়ো, বেগুন, পুঁইশাক, ঢেড়শ সাথে ছোট বড় নানান আকারের আইস্ক্রীমের বাক্স ভর্তি খাবার।এসব নিয়ে, ইয়াসিন সাহেব তার ড্রাইভিং সীটে বসা পুত্র নওশাদের সাথে ফিরে আসছিলেন। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে নওশাদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি কি ঠিক আছো বাবা?”

ইয়াসিন সাহেব ডান হাত দিয়ে বুকের বাঁ পাশ চেপে ধরে ছিলেন। ছেলের প্রশ্ন শুনে তড়িঘড়ি হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন,

” হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ আছি, ফার্স্ট ক্লাস।”

নওশাদের মুখ কুঁচকে গেল।

সে চিড়বিড় করে বলে উঠলো,

” এত বাজে রাস্তা যে হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে গেল, মাসও হয়নি তোমাকে যে সাতশো ডলারের জুতোটা কিনে দিলাম-নষ্ট হতে লাগলো এক সেকেন্ড ! হাতে করে জুতো নিয়ে কাদায় ডুবে ডুবে মাইল খানেক হাঁটলাম। সারাদিন একশ টাকার ময়লা চপ্পল পরে দমবন্ধ ড্রয়িং রুমে বসে রইলাম। বাসায় এসি তো দুরের কথা একটা আইপিএস পর্যন্ত নাই। ফ্যান ঘোরে তো ঘোরে না। আধ ঘন্টা ইলেক্ট্রিসিটি থাকলে দুই ঘন্টা নাই। গরমে আমার মাথা পাগল অবস্থা। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ওয়াশ রুমে পানির সাপ্লাই নাই। ড্রাম থেকে নিয়ে পানি ইউজ করতে হয়।

আমার খুবই জানতে ইচ্ছে করছে, এত কিছুর পরেও তুমি কিভাবে ফার্স্ট ক্লাস আছো বাবা?”

বহুবছর পরে ইয়াসিন সাহেব, খুব অল্পদিনের জন্য ছেলে নওশাদকে নিয়ে দেশে ফিরেছেন এবং প্রথমেই ওনার ছোটবেলার বন্ধু জামিলুরের সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।

” বর্ষা বাদলার দিনে গ্রামের রাস্তা এমনই হয়৷ আর, তুই তো শুধু অসুবিধে গুলোই দেখলি! এত আদর-ভালবাসা-আন্তরিকতা এগুলো তোর চোখে পড়লো না?

আশ্চর্য! যেভাবে জুতোর দাম বললি মনে হচ্ছে, আমি কোন ছেলের বাবা না, প্রাইজ ট্যাগের বাবা।”

” শোনো, তুমি যত যাই বলোনা কেন, এই প্রথম, এই শেষ। আমরা আর কখনোই তোমার বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি না। খুব দরকার হলে,

উনাকে আসতে বলবে তুমি ।

তাছাড়া, যে অবস্থা, এত দূরে থাকে- এরকম বন্ধুত্ব রাখার দরকারটাই বা কী! আমি তো বুঝি না।”

ছেলের কথা শুনে ইয়াসিন সাহেবের খুব মন খারাপ হলো। বিদেশে পাড়ি দেবার আগের কঠিন জীবনে এই বন্ধুই তাকে সববিষয়ে সাহস যুগিয়েছে। তাছাড়া, আসার সময় বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ” আবার কবে আসবি?”

“খুব তাড়াতাড়ি” বলে তাকে কথাও দিয়ে এসেছিলেন উনি।

ধান তোলার মৌসুমে জামিলুরের পক্ষে ক্ষেত- খামার রেখে তার সাথে দেখা করতে আসার সময় বের করা খুবই মুশকিল। তাই, উনি জোর করতে পারেন না। ছেলের ওপর অভিমান করে ছেলেকেও আর নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন না।

দেখতে দেখতে দেশ ছাড়ার সময় হয়ে গেল, ফিরতি টিকেটও কনফার্ম করা ছিলো। এর মাঝেই, এক রাতে স্ট্রোক করলেন ইয়াসিন সাহেব। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো।

নওশাদ চোখে অন্ধকার দেখলো।

বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে, ওর স্ত্রী চাইলেই চলে আসতে পারছে না। হাস্পাতালে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব নেবার মতো কোন আত্নীয়-স্বজনকেও সে খুঁজে পাচ্ছে না। একথা জামিলুরের কানে পৌঁছালে সে নিজের সব কাজ বন্ধ রেখে হাস্পাতালে এসে বন্ধুর যত্ন এবং শুশ্রূষার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। ইয়াসিন সাহেব যতদিন অসুস্থ ছিলেন, জামিলুর সাহেব সর্বক্ষণ তার পাশে থেকে যত্ন করেছিলেন। উনাকে কাছ থেকে দেখে নওশাদ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলো। বুঝতে পেরেছিলো, বন্ধুর বাড়িতে শান- শওকত কিংবা আইপিএস আর পানির লাইন থাকাটা জরুরী নয়, শুধু বন্ধুত্ব থাকাটাই জরুরী । সে যাত্রায় অবশ্য নওশাদের এই পরিবর্তন দেখার সুযোগ ইয়াসিন সাহেবের ভাগ্যে জোটেনি৷ উনি চিরবিদায় নিয়েছিলেন। শোক অতর্কিতে এলেও নওশাদ ভেবেছিলো, নিজের মন সে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু, মাটিতে লাশ নামানোর পূর্বমুহূর্তে দেখা গেল, ইয়াসিন সাহেবের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে পাগলের মতো এলোপাথাড়ি হাত পা ছুড়ে কাঁদছে আর চিৎকার করে বলছে,

” কেন চলে গেলে বাবা?”

জামিলুর সাহেব শক্ত হাতে ওকে ফিরিয়ে এনে, মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সামলানোর চেষ্টা করলেন।বললেন,”এতো কাঁদিস নারে বাবা! তোকে কতো ভালোবাসতো আমার প্রাণের বন্ধুটা! তোর কান্না দেখে ওর-ও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!”

কথা শুনে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নওশাদের বুক দমকে দমকে ওঠে। যেন ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে। সেই দমকের ওপর মায়া হয়ে যায় জামিলুরের ছায়া। সে সন্তান স্নেহে নওশাদকে বুকের ওপর জাপটে ধরে বলতে থাকেন,

“শান্ত হ বাবা! শান্ত হ!”

নওশাদ হঠাৎ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে শুরু করে, ওর বাবা, ইয়াসিন সাহেব, আসলেই ওর আশেপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। ওর দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটে আংগুল দিয়ে ইশারায় ওকে যেন বারবার শান্ত হতে বলছেন।

লেখক- সার্মন মৌরী

৮ thoughts on “ছায়া মায়া
সার্মন মৌরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *