কোনো শিল্পীর প্রকাশিত সংকলন বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৭ তম জন্মদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।

দায়বদ্ধতার শিল্পী জয়নুলতারিক ফেরদৌস খানশিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর শিল্পী-জীবন ও শিল্প-দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন- সমগ্র মানবজাতির জন্য সুন্দর জীবন নির্মাণ করাই হচ্ছে শিল্পকলার মৌল উদ্দেশ্য। আমি প্রায়ই বলি, একটি সুন্দর রঙ সুন্দর, কিন্তু তার চেয়ে বেশী সুন্দর হলো একটি সুন্দর মুখাবয়ব- তারও চেয়ে সুন্দর একটি সুন্দর মন বা সুন্দর চরিত্র। মন ও চরিত্রকে সুন্দর করার জন্য অন্যান্য অনেক গুণের সাথে শৈল্পিক গুণ থাকা এবং শিল্পকলার প্রতি গভীর অনুরাগ থাকা বাঞ্জনীয়।

জয়নুল আবেদিন প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ছবি এঁকেছেন, মহৎ শিল্পী হবার আকাঙক্ষায় নয়, নিজের জীবনকে, অপরের জীবনকে সুন্দর করার জন্য। তিনি ছবি এঁকেছেন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে তুলে ধরবার জন্য, জীবনে যা সুন্দর এবং জীবনে যা সুন্দর নয় তাকেও দেখাবার জন্য, জীবনে সুন্দর প্রতিষ্ঠায় যে শক্তি বিরোধিতা করে তাকেও চিহ্নিত করার জন্য। যে ছবি মানুষকে সুন্দরের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই হচ্ছে মহৎ ছবি, যে শিল্পী তা পারেন তিনি মহৎ শিল্পী। তিনি বলতেন- আমার সারা জীবনের শিল্প সাধনা ও শিল্প আন্দোলনও আমার জীবনকে এবং আমাদের সবার জীবনকে সেই সুন্দরের দিকে নিয়ে যাবার আন্দোলন।

জয়নুল ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকলেন। হৃদয়বিদারক সে ছবি। তিনি বললেন, “মানুষ আর কুকুর একলগে যখন ডাস্টবিনের খাওন লইয়া কাড়াকাড়ি কইরা খায় তখন বুকটা ফাইটা যায়। এই কথা দুনিয়ার মাইনষেরে আমি কইছি- ছবিতে ধইরা দেহাইছি, মানুষ কতো নিষ্ঠূর অইতে পারে। মানুষ তার ভাইয়েরে কেমনে কুত্তার পাশে নামাইতে পারে।”সে সময় তাঁর নির্বাচিত বারোটি স্কেচ নিয়ে একটি অ্যালবাম বের হয়, যার নাম ছিল ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’। এই অ্যালবামটি গ্রন্থণা করেছিলেন ইলা সেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অ্যালবামটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কপি শেষ হয়ে যায়। বুভুক্ষু মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণা শিল্পীর তুলিতে কী হৃদয়বিদারক রূপ পরিগ্রহ করতে পারে তার জ্বলন্ত নিদর্শন ছিল জয়নুলের সেই দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা। উপনিবেশিক সরকারের ভিত কাঁপানো এ অ্যালবামটি হয়ে উঠেছিল সেদিন দুর্ভিক্ষের জীবন্ত এক দলিল। ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’ অ্যালবামটির জনপ্রিয়তা ও সমাজে এর প্রতিক্রিয়া উপলদ্ধি করে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে সেটিকে বাজেয়াপ্ত করে। সংকলনটিকে দর্শকের সামনে থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন শিল্পী ও প্রকাশক। কোনো শিল্পীর প্রকাশিত সংকলন বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।

আজও যখন এই দেশ কিংবা এই পৃথিবীর কোনও প্রান্তে অনাহারে মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসে তখন জয়নুলের ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’–এর রেখাগুলি বর্শার ফলার মতো তীক্ষ্ম হয়ে আমাদেরকে বিদ্ধ করে। জয়নুল আবেদিন বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন সব সময়। তিনি শিল্পকলাকে মনে করতেন সমাজ পরিবর্তণের হাতিয়ার হিসেবে। আর্নস্ট ফিসারের ‘দি নেসেসিটি অব আর্ট’ গ্রন্থেও শিল্প বিষয়ে বিশদ আলোচনায় আমরা দেখতে পাই- “আদিম গোষ্ঠী সমাজে একজন জাদুকর খুব গভীর অর্থেই ছিল গোষ্ঠীর মুখপাত্র, গোষ্ঠীর একজন সেবাদাস। তার জাদুর ক্ষমতা এমনই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে, গোষ্ঠীর প্রত্যাশা পূরণে বার বার ব্যর্থ হলে তাকে মেরে ফেলা হতো। নতুন শ্রেণি-সমাজে জাদুকরের ভূমিকাটি শিল্পী ও পুরোহিতদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। পরর্বতীতে এদের সঙ্গে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক যুক্ত হয়। শিল্প ও উপাসনার মধ্যকার সম্পর্কটি ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ে এবং শেষে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও অলক্ষ্যেই শিল্পী আমাদের সমাজের প্রতিনিধি বা মুখপাত্র থেকে যান। শিল্পী জনগণকে তার ব্যক্তিগত বিষয়াদি দ্বারা ভারাক্রান্ত করবে এমনটি তার কাছে আশা করা হয় না। তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। উপরন্তু তার সমাজ, শ্রেণি ও যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং চিন্তাধারার প্রতিফলনে তিনি কতটা সমর্থ, তার দ্বারা তাকে বিচার করা হয়। সমাজের মানুষের কাছে বিরাজমান ঘটনাসমূহের গভীর তাৎপর্য তুলে ধরা শিল্পীর মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়।”সমাজের নানা অসংগতি একজন শিল্পীর চোখে যতো দ্রুত প্রতিপাদ হয়, সমাজের অন্য কারো চোখে তা হয় না। আর এজন্যই সমাজে একজন শিল্পী অন্যের থেকে আলাদা।

একজন শিল্পী সমাজের অসংগতি দেখেন এবং শিল্পকলার মাধ্যমে দ্রুত সে অসংগতি তুলে ধরেন। সে অর্থে একজন শিল্পী আজো আমাদের সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং যুগ যুগ ধরে সমাজের বৃহত্তর অংশের অলক্ষ্যেই তাঁদের এ প্রতিনিধিত্বশীলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। শিল্পী জয়নুল সে কাজটিই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অলক্ষ্যচারী হয়ে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সমাজে বিরাজমান অসংগতির চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।সমাজের সংগঠিত নানা অসংগতির উপর শিল্পীর মরমিয়া দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটি বিখ্যাত বিবৃতিতে পিকাসো জানিয়েছেন: “শিল্পীকে কী ভাবো তোমরা? নিছক নির্বোধ ? যদি আঁকিয়ে হয় তো তার শুধু চোখ থাকে ? যদি গাইয়ে হয় শুধু কান ? কিংবা যদি কবি হয় তাহলে মনের প্রতিটি স্তরে একটি করে বীণা ? … একেবারেই উল্টো ! সেই সঙ্গে একজন শিল্পী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব- হৃদয়বিদারক, উত্তেজক বা সুখপ্রদ ঘটনার প্রতি সবসময় সজাগ, সবরকম ভাবে সাড়া দিতে তৈরি! এটা কী করে সম্ভব যে অন্য কোনো মানুষ সম্পর্কে কোনো আগ্রহ সে বোধ করে না ? যে জীবনকে একজন শিল্পী এতো আন্তরিকভাবে তুলে ধরছেন- কী করে বা সেই জীবন থেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেবে নিজেকে ? না, ঘর সাজানোর জন্য ছবি আঁকা হয় না। শত্রুকে আক্রমণ বা শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছবি। ছবি আসলে সংগ্রামের হাতিয়ার।

“শিল্পীর উপরোক্ত বক্তব্য যে নিছক তাৎক্ষণিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, তারই প্রমাণ পাই তাঁর ‘গোয়ের্নিকা’ ছবিতে। অনেকের মতেই যা বিংশ-শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম, মানুষের সৃজন-সুকৃতির উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি। মানবিক মূল্যবোধের হিংশ্রতম শত্রু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শান্তিকামী মানুষের জাগ্রত বিবেক আর নিরন্তর সংগ্রামের অভিব্যক্তি এই অতুলনীয় শিল্পকর্মটি। ‘গোয়ের্নিকা’ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি স্বরূপ, যুদ্ধ বিয়োগান্তক এবং বিশেষ করে নিরপরাধ বেসামরিক জনগনের উপর বর্বরতা ও যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। স্পেনীয় সরকারের একটি কমিশনের অধীনে ১৯৩৮ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য এই দেয়ালচিত্র বা ম্যুরালটি পিকাসো তৈরি করেন। ‘গোয়ের্নিকা’য় পিকাসো মানুষ ও জীবজন্তুর যন্ত্রণা ও বাড়িঘরের ভেঙ্গেচুরে যাওয়ার অরাজকতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘গোয়ের্নিকা’র ঠিক ছয় বছর পরে কলকাতার রাস্তায় মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়কে তুলে ধরলেন জয়নুল। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের এ চিত্রমালা কেবল অস্থিসার মানুষের কঙ্কালের ছবি নয় নিশ্চয়ই! মানবতার শত্রু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এও যে চরম চপেটাঘাত। আক্ষরিক অর্থে পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’ এবং জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার মধ্যে কোনো মৌল পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল প্রকাশ ভঙ্গিতে। সে অর্থে দুটি ছবির মূল উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। জয়নুল তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রের মাধ্যমে মানবতার শত্রুদের আরও নগ্ন করে দেখালেন, আরও স্পষ্ট করে বললেন এসব তোমাদেরই সৃষ্টি। সেই সাথে তিনি এও বোঝাতে চাইলেন যে, এই পৃথিবীতে মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ যেন আর কখনই ফিরে না আসে।

————-
লেখক : তারেক ফেরদৌস খান ।
সহকারী পরিচালক । বাংলা একাডেমি ।

৩ thoughts on “কোনো শিল্পীর প্রকাশিত সংকলন বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *